ভুলে ভরা লাইনে একটি শোকজ লেটার , অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। গত ২৪ মার্চ জয়পুরহাট জেলার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রেজওয়ান হোসেন।তিনি ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুর রহমানকে তলব করেছেন।
রমজান মাসে স্কুল খোলার খবর শুনে শিক্ষক মাহবুবুর রহমান হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের দুঃখ প্রকাশে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, তিনিও অল্প সময়ের মধ্যে তা মুছে দেন।
শিক্ষক মাহবুবারের যে লেখাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি তাতে রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু আছে বলে মনে হয় না। সেই রমজানে স্কুলের ক্লাস বন্ধ রাখার দুঃখজনক অনুরোধ। শিক্ষক তার ভুল বুঝতে পেরে তা মুছে দেন। ভুল বোঝাবুঝি অনেক অনুশোচনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে মাটি খুঁড়ে তাকে অজুহাতে তলব করা অনেকটা নির্দেশিত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিবেচিত হতে পারে।
এই লেখার মাঝখানে একটা প্রাথমিক পাঠ্যবই থেকে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পের প্রধান চরিত্র ছিল কামারের ছেলে মাহবুব। মালিক পক্ষ নানা কারণে মাহবুবকে নির্যাতন করতো। মাহবুব ছিলেন খুবই ভীরু প্রকৃতির। যখন সে খেত তখন তার মধ্যে সবসময় ভয় থাকত। একদিন বাড়ির মালিক মাহবুবকে পাশের গ্রামের একটি দোকান থেকে পান আনার নির্দেশ দেন। প্রবল বৃষ্টি আর কাদা উপেক্ষা করে সে তার মনিবের নির্দেশে ছুটে গেল। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে মাহবুব মন থেকে পালিয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবল, এই ভয়ংকর ঝড় থেকে সে বেঁচে গেছে। এটা তাকে সাহস জুগিয়েছে। এরপর থেকে মাহবুব আসামী ও সাহসী হয়ে ওঠে। সকল অন্যায়, অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আগামী প্রজন্মকে সাহসী করে গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষক সমাজকে সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে হবে।
লাইনে ভুলের জন্য আমি জনাব ডিপিইওকে দায়ী করব না। সে হয়তো পড়াশোনায় কিছুটা অমনোযোগী ছিল। আমাদের শিক্ষকদের অবহেলার কারণে এত ক্লাসে সে কীভাবে ডিগ্রি পেল। এর সঙ্গে লুকিয়ে আছে শিক্ষাব্যবস্থার দারিদ্র্য। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাসভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক নয়। প্রশ্ন থেকে যায়, ভুল কর্মকর্তা কীভাবে এ পর্যায়ে এলেন? আমি এই আলেমদের শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক বা কর্মকর্তা না হওয়ার জন্য সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
জ্ঞানভিত্তিক মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছি। আশা করি, সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক অনুভূতির সঙ্গে বিষয়গুলো উপলব্ধি করবেন। প্রথমত, শিক্ষার মূল উপাদান শিক্ষক সংকট।
প্রাথমিক শিক্ষা মনে হয় – ভুল সবই ভুল
শিক্ষক সংকট: আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো, ঘরে ভাত থাকলে তা লবণ, গোলমরিচ ও পানি দিয়ে গুঁড়ো করে খেলে পেট ভরে। শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। সুবিশাল সুসজ্জিত ভবনগুলোও শিক্ষক সংকটে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শিগগিরই ৪৫ হাজার শূন্য পদ পূরণ করতে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির স্বপ্ন ভুলে গেছেন সহকারী শিক্ষকরা। প্রধান শিক্ষকের জন্য বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ। এখানে বলতে হচ্ছে, এত শূন্যতার মাঝে প্রাথমিক শিক্ষার মান ও সম্মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা কতটা যৌক্তিক? প্রতিটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই বছরের বেশি সময় লাগে। 2014 খ্রিস্টাব্দের নিয়োগ প্রক্রিয়া 2016 খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয়েছে। এভাবে শিক্ষকদের মৃত্যু, অবসর বা প্রস্থানের কারণে হাজার হাজার শিক্ষকের শূন্যপদ সৃষ্টি হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেকটা ‘নাদির একুল ভাঙ্গে, ওকুল গরে এত নাদির খেলা’ গানের মতো। প্রাথমিক শিক্ষায় এই ভাঙা খেলাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানসম্মত শিক্ষার মূল চ্যালেঞ্জ দূর হবে।
দক্ষ শিক্ষক, জনশক্তি সংকট
মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন, যোগ্য, দক্ষ অভিজ্ঞ শিক্ষক কর্মকর্তাদের পেশায় আকৃষ্ট করা। তবে সম্মানজনক বেতন না থাকায় মেধাবী শিক্ষকরা আসতে আগ্রহী নন। আসলে প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো ক্যাডার সার্ভিস না থাকায় শিক্ষকতা কর্মকর্তারা এ পেশায় মনোযোগ দেন না। আপনি আপনার দায়িত্ব অত্যন্ত সদয়ভাবে পালন করেন। নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তারা প্রাথমিক শিক্ষায় অন্যান্য পেশার অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করেন। এ মন্ত্রণালয়ে অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক সময় শিশু শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোতাবেক কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। এতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য সহকারী শিক্ষক পদে বহাল রেখে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টির মাধ্যমে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক ও জনবল সংকট দূর করা সম্ভব।
শুধুমাত্র দক্ষ, অভিজ্ঞ জনবলই মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারে।
অবিচল কাজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলা কর্মসূচি সকল ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে। শুধু প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় যৌক্তিক সমস্যা সমাধানে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য যথাসময়ে অর্জনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যৌক্তিক সমস্যা সমাধানে বিলম্বের কারণে প্রাথমিকের বিভিন্ন সমস্যা মাননীয় হাইকোর্টের মাধ্যমে সমাধান করতে হয়েছে। ফলে চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি বেড়েছে। এ অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষাকে গতিশীল করতে জবাবদিহিতা অপরিহার্য।
গুজব: প্রাথমিক শিক্ষায় গুজব প্রচুর। গুজব শুধু সাধারণ শিক্ষকরা ছড়ায় না। গসিপ মানে মিথ্যা ছড়ানো। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই প্রাথমিকের সাবেক সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষকদের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া গুজবের শামিল। ইদানীং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্র বা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে দেখা গেছে। প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ না করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ভুল এড়িয়ে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ